হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, আলোচ্য প্রবন্ধে ইমাম হোসাইন (আ.)’র শাহাদাতের চেহলাম বার্ষিকী বা আরবাইনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ইমাম হোসাইন (আ.) আরবাইনে জিযারত পালন জায়েজ কিনা, বর্তমানে চেহলাম বা আরবাইন পালনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং এটি পালন বেদাত বা হারাম কি না এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ইমাম হোসাইনের (আ.) চেহলাম বার্ষিকী বা আরবাইনের ঐতিহাসিক ভিত্তি:
প্রথমে আ রবাইন কী সে সম্পর্কে আলোচনা করব। আরবাইন (اربعین) বা আরবাঊন (اربعون) আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে চল্লিশ বা চল্লিশতম। আল-ইয়াওমুল আরবাঊন বা আল-ইয়াওমিল আরবাঈন হচ্ছে চল্লিশতম দিন। বাংলাদেশে মৃত্যুর পর চল্লিশতম দিবসে মৃত ব্যক্তির স্মরণে যে ইসালে সওয়াব ও দুয়ার অনুষ্ঠান করা হয় তাকে চল্লিশা বা চেহলাম (ফার্সী শব্দ) বলা হয়ে থাকে।
আর ইমাম হোসাইন (আ.) কারবালায় ১০ মুহাররম অর্থাৎ আশুরার দিনে শাহাদাত বরণের পর চল্লিশতম দিন অর্থাৎ ২০ সফরকে আরবাইন বলা হয়। আর এ দিনে ইমাম হোসাইন এবং তার সঙ্গীসাথিদের স্মরণে শোকানুষ্ঠান বা আযাদারি পালন ও জিয়ারত করা হয়। আর এ জিয়ারত হচ্ছে মুস্তাহাব।
২০ সফর অর্থাৎ ইমাম হোসাইন (আ.)’র আরবাইন উপলক্ষে জিয়ারত ও দুআগুলো বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদিস ও দুআর গ্রন্থ যেমন: শেখ তূসী প্রণীত তাহযীবুত তাহযীব ও মিসবাহুল মুতাহাজ্জিদ এবং শেখ আব্বাস কোম্মী প্রণীত মাফাতীহুল জিনান ইত্যাদি গ্রন্থে বর্ণিত আছে। ইমাম হোসাইন (আ.)’র আরবাইনসহ সকল জিয়ারতে যেসব দুআ তথা মহানবী (সা.), হযরত ফাতেমা (সা.আ.), হযরত আলী (আ.), ইমাম হাসান এবং আহলে বাইত (আ.)’র অন্য সকল ইমাম (আ.)'র জিয়ারতে যেসব দুআ পড়া হয় তার অন্তর্নিহিত অর্থ অত্যন্ত উচুঁ মানের একইসাথে উচুঁ পর্যায়ের মারেফাত ও তাত্ত্বিক ইসলামী জ্ঞানে পরিপূর্ণ।
ফলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আসলে ইসলামী তাত্ত্বিক জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও মারেফাতের ভাণ্ডার হচ্ছে এ সব দুআ ও জিয়ারতনামা। আমরা সংক্ষেপে ইমাম হোসাইন (আ.) র আরবাইনের জিয়ারতের দুয়ার মূল বিষয়গুলো উল্লেখ করছি!
প্রথমত: ইমাম হোসাইনের উপর সালাম দেয়া হয়েছে। এরপর তাঁর পরিচিতি এবং তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা, আল্লাহর রাহে তাঁর জিহাদ, ধৈর্য-সবর ও শাহাদাত বরণের সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল যে তাঁর মাতামহ হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উম্মতকে বিচ্যুতি ও গোমরাহী থেকে রক্ষা করা। এসব বিষয় এতে বর্ণিত হয়েছে।
এরপর ইমাম হোসাইনের হত্যাকারীদের উপর লানৎ দেয়া হয়েছে। তারপর তাঁর আধ্যাত্মিক মাকাম এবং তাঁর সকল কর্মকাণ্ড ও গোটা জীবন যে সুমহান ইসলামী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তিনি যে মহান আল্লাহ পাকের ঐশী প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়ন, আল্লাহর রাহে জিহাদ করে মজলুমভাবে শহীদ হয়েছেন এ সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করা হয়েছে।
তারপর মহানবী (সা.) এর সুন্নাহ অনুসরণ করে ইমাম হোসাইনের মুহাব্বতকারী ও অনুসারীদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন এবং তাঁর শত্রু ও হত্যাকারীদের প্রতি শত্রুতা ও ঘৃণা প্রদর্শনের কথা বর্ণিত হয়েছে।
এরপর তাঁর ইমামতের ব্যাপারে সাক্ষ্যদান এবং তাঁর প্রতি জিয়ারতকারীর আনুগত্য এবং তাঁকে সাহায্য করার জন্য জিয়ারতকারীর সদাপ্রস্তুত থাকার ব্যপারেও সাক্ষ্যদান করা হয়েছে, যাতে করে আল্লাহ পাক যেন তাকে অর্থাৎ জিয়ারতকারীকে এ দুনিয়া ও আখেরাতে ইমাম হোসাইন (আ.) এর সাথে রাখেন। ইমাম হোসাইন ও আহলুল বাইতের শত্রুদের সাথে নয় এবং শেষে ইমাম হোসাইন (আ.) ও আহলে বাইত এর উপর দরুদ প্রেরণ করা হয়েছে।
এবার, আরবাইনের ঐতিহাসিক ভিত্তি ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলছি:
মশহুর (প্রসিদ্ধ) অভিমত হচ্ছে যে ২০ সফর ৬১ সালে বন্দিত্বদশা থেকে মুক্তি পাবার পর দামেস্ক খেকে মদীনা প্রত্যাবর্তনকালে ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) এবং আহলে বাইত (আ.) র কাফেলা কারবালা আগমন করেন এবং ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) শহীদদের নেতা মজলুম ইমাম হোসাইন (আ.) ’র কাটা মাথা কবরে শুইয়ে দিয়ে তাঁর দেহের সাথে যুক্ত করে দাফন করেন।
সেখানে তারা ৩ দিন অবস্থান করে শহীদদের নেতা এবং তাঁর শহীদ সাথীদের জন্য আজাদারি করেন।
আবার তাবেয়ী আতা থেকে বর্ণিত আছে-আমি (রাসুলুল্লাহর সাহাবী জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আল-আনসারীর সাথে (হিজরী ৬১সালের) ২০ সফর গাযেরিয়ায় (কারবালা) পৌঁছাই। জাবির (রা.) ফুরাত নদীতে গোসল করে পবিত্র একটি পোশাক পরেন। এরপর তিনি বলেন- আতা তোমার সাথে সুগন্ধি কিছু আছে কি। আতা বললেন আমার সাথে কিছু সুউদ (এক ধরণের সুগন্ধি) আছে। তখন তিনি তা থেকে কিছু নিয়ে মাথা ও গায়ে মাখেন এবং খালি পায়ে ইমাম হোসাইন (আ.) এর কবর জিয়ারত করতে গেলেন।
কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ৩ বার আল্লাহু আকবর বলেন এবং এরপর তিনি মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে তাকে আমি বলতে শুনলাম-‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আলাল্লাহ’ অর্থাৎ ১৫ রজবে যে জিয়ারতনামা পড়া হয় সেটার মতোই (দ্রঃ মাফাতীহুল জিনান,পৃষ্ঠা- ৮৫৮)।
আর এটাই হচ্ছে ইমাম হোসাইন (আ.) ’র আরবাইনের (চেহলাম) প্রথম জিয়ারত। এরপর থেকে এ জিয়ারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান বিশেষ করে ইরাকে।
ইমাম হোসাইন (আ.) ’র চেহলাম বার্ষিকী বা আরবাইনের জিয়ারত পালন জায়েজ হওয়া সংক্রান্ত শরয়ী দলিল
ইমাম হোসাইন (আ.) ’র শাহাদাতের চেহলাম বা আরবাইনের শোক ও জিয়ারত পালন জায়েজ। আর এর জায়েজ হওয়া সংক্রান্ত দলিল দু ধরণের।
প্রথমত: সর্বসাধারণ (আম) দলিল যা হচ্ছে সূরা হজের ৩৬ নং আয়াতঃ আর যে ব্যক্তি আল্লাহর (দ্বীনের) নিদর্শনসমুহের (শাআয়িরুল্লাহ) সম্মান প্রদর্শন করে তাহলে তা হবে তার হৃদয়ের তাক্ওয়ার নির্যাস। যেখানে সাফা-মারওয়া পাহাড় এবং কুরবানীর উটকে আল্লাহ পাকের দ্বীনের নিদর্শনাদির (শাআয়িরুল্লাহ) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সেখানে নিঃসন্দেহে মহান নবী, ওয়ালী, নেক-সালেহ, সিদ্দীক ও শহীদগণ যে হবেন আল্লাহ পাকের দ্বীনের সর্বশ্রষ্ঠ নিদর্শন তা বলার আর অপেক্ষা ব়াখে না।
তাই এসব পূণ্যবানদের সম্মান বা তাযীম প্রদর্শন হবে নিঃসন্দেহে অন্তঃকরণসমুহের তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ। তাঁদের প্রতি অসম্মান ও বেআদবি করলে অন্ততঃপক্ষে তাদের ব্যাপারে নির্বিকার,নিস্পৃহ,নির্লিপ্ত ও উদাসীন থাকলে মনের যে তাক্ওয়া অর্জিত ও বিকশিত হবে না।
বরং আল্লাহ পাকের দ্বীন ও হযরত সালেহ (আ.) এর মুজেযা ও নুবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ ও নিদর্শন উষ্ট্রীর অসম্মান ও তা হত্যা করার কারণে সালেহ (আ.) র কওম যে আল্লাহর আজাবে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সেরকম বালা-মুসিবতে পড়বে ও অভিশপ্ত হবে সে বিষয়টি এ আয়াত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের দ্বীনের নিদর্শনস্বরূপ মহান নবী ও ওয়ালীদের যারা অসম্মান ও অশ্রদ্ধা করবে তারা নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর গজব ও লানতের পাত্র হবে এবং আল্লাহ পাক তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন।
যে ইমাম হোসাইন (আ.) বেহেশতের যুবকদের নেতা এবং যাঁর ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন- ‘হোসাইন (আ.) আমা হতে এবং আমি হোসাইন হতে’। সেই হোসাইন (আ.) আল্লাহ পাকের সর্বশ্রেষ্ট নিদর্শনাদির অন্তর্ভূক্ত যার সম্মান ও তাযীম হবে অন্তরের তাক্ওয়া বিকশিত হওয়ার কারণ।
তাঁর প্রতি সম্মান ও তাযীমের স্বরূপ হচ্ছে তাঁর সুখ ও আনন্দে সুখী হওয়া ও আনন্দ প্রকাশ করা এবং তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে মজলুমাবস্থায় কারবালায় শহীদ করে তাঁর পরিবারবর্গকে বন্দী করার কারণে তাঁর জন্য শোকপ্রকাশ ও আযাদারী করা।
মহান আল্লাহর ওয়ালীর প্রতি তাযীম ও সম্মানের বাস্তব নমুনা হচ্ছে উক্ত ওয়ালীর সুখে সুখী হওয়া এবং তাঁর দুঃখে দুঃখী হওয়া। আর ইমাম হোসাইনের শাহাদত দিবসে (১০ মুহররম) এবং আরবাইন (চেহলাম) উপলক্ষে তাঁরই জিয়ারত ও শোকানুষ্ঠান পালন নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর নিদর্শনাদির সম্মান ও তাযীমের বাস্তব নমুনাস্বরূপ।
শুধু তাই না বছরের যে কোন দিন ও সময়ে বেহেশতের যুবকদের নেতার জন্য শোকপ্রকাশ ও আজাদারি করা যে কাম্য ও মুস্তাহাব তা উক্ত আয়াতের সর্বজনীনতা (উমূম) ও নিঃশর্ততা (ইতলাক) থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়।
[সংগৃহীত ও পরিমার্জিত]